পেশোয়া তন্ত্রের ইতিহাস

পেশওয়া হল মারাঠা সাম্রাজ্যের একটি প্রশাসনিক পদ । একজন পেশোয়ার দায়িত্ব ছিল বর্তমানকালের প্রধানমন্ত্রী পদমর্যাদার অনুরূপ। ইনি সমগ্র শাসনব্যবস্থার তত্ত্বাবধানে ছিলেন এবং রাজার অবর্তমানে তিনি তার প্রতিনিধিত্ব করতেন । প্রকৃতপক্ষে, পেশওয়ারা মারাঠা রাজাদের (ছত্রপতি) অধস্তন হিসেবে কাজ করতেন। কিন্তু পরবর্তীতে, কার্যত তারা মারাঠাদের নেতা হয়ে উঠেন এবং ছত্রপতিরা নামমাত্র শাসকে পরিণত হন। বালাজি বিশ্বনাথের আগে পেশোয়া পদের অস্তিত্ব থাকলেও পেশোয়াপদ আসল গুরুত্ব পায় বালাজি বিশ্বনাথের সময় থেকেই ।

বালাজি বিশ্বনাথ (১৭১৩-১৭২০)

  • ১৭১৩ খ্রিস্টাব্দে শাহু বালাজি বিশ্বনাথকে পেশােয়া পদে নিয়ােগ করেন এবং সেনাকর্তা উপাধি দেন।
  • বালাজি বিশ্বনাথকে পেশোয়াতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা মনে করা হয় ।
  • তিনি পেশোয়া পদটিকে বংশানুক্রমিক করে তোলেন।
  • ১৭০৭ খ্রিস্টাব্দে বালাজি বিশ্বনাথের সহযোগিতায় শাহু খেদের যুদ্ধে তারাবাইকে হারিয়ে সাতারা দখল করেন এবং সাতারার সিংহাসনে বসেন।
  • বালাজি বিশ্বনাথ সৈয়দ ভ্রাতৃদ্বয়ের সঙ্গে একটি সন্ধি করেন ১৭১৯ খ্রিস্টাব্দে এবং ফারুকসিয়ারের বিরুদ্ধে সৈয়দ ভাতৃদ্বয়ের অভিযানকে সমর্থন করেন।
  • মুঘলরা শাহুকে নিজ রাজ্যের রাজা হিসাবে স্বীকার করেন এবং শাহুকে ছটি মুঘল প্রদেশ (ঔরঙ্গাবাদ, বেরার, বিদর, বিজাপুর, গােলকুন্ডা ও খান্দেশ) এর চৌথ ও সরদেশমুখী কর আদায়ের অনুমতি দেন। শাহু মুঘলদের বার্ষিক ১০ লক্ষ টাকা কর দিতে সম্মত হন।
  • ১৭১৪ খ্রিস্টাব্দে মারাঠা নৌবাহিনীর প্রধান কঙ্গোজি আংরের সঙ্গে বালাজি বিশ্বনাথের নােনাবেলার সন্ধি হয়।
  • ১৭১৯ খ্রিস্টাব্দে মুঘলদের সঙ্গে সন্ধিকে স্যার রিচার্ড টেম্পল ‘মারাঠা সাম্রাজ্যের ম্যাগনাকার্টা’ বলে অভিহিত করেন।
  • ১৭২০ খ্রিস্টাব্দে বালাজি বিশ্বনাথের মৃত্যু হয় ।

প্রথম বাজিরাও (১৭২০-১৭৪০)

  • বালাজি বিশ্বনাথের মৃত্যুর পরে তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র প্রথম বাজিরাও মাত্র ২০ বছর বয়সে পেশোয়ার দায়িত্ব সামলান ।
  • প্রথম বাজীরাওকে সকলে “থোরেল ( Thorale )’ বা জ্যেষ্ঠ বাজিরাও বলে ডাকতেন।
  • তিনি গেরিলাযুদ্ধ পদ্ধতিতে পারদর্শী ছিলেন।
  • ১৭২০ খ্রিস্টাব্দে বলপুরের যুদ্ধে, ১৭২৮ খ্রিস্টাব্দে পালখেটের যুদ্ধে, ১৭৩১ খ্রিস্টাব্দে ধাবােই-এর যুদ্ধে এবং ১৭৩৮ খ্রিস্টাব্দে দুরাইশারাই-এর যুদ্ধে নিজামকে পরাস্ত করেন।
  • দুরাইশারাই সন্ধি দ্বারা নিজামের কাছ থেকে মালব ও বুন্দেলখন্ড দখল করেন।
  • নিজামের সঙ্গে ধাবই-এর যুদ্ধের ফলে নিজাম শাহুকে মারাঠা অধিপতি ও দাক্ষিণ্যাত্যে চৌথ ও সরদেশমুখী অধিকারের অধিকারী বলে মেনে নেন।
  • দুরাইশরাই সন্ধি দ্বারা প্রথম বাজিরাও নিজামের থেকে ৫০ লক্ষ টাকা পান।
  • ১৭২২ খ্রিস্টাব্দে জানজিরার সিদ্ধিদের তিনি পরাস্ত করে বিতাড়িত করেন।
  • ১৭৩৯ খ্রিস্টাব্দে বাজিরাওয়ের ভাই চিমজি আপ্পারাও-এর নেতৃত্বে মারাঠারা পাের্তুগীজদের পরাজিত করে সলসেট ও বেসিন দখল করেন।
  • ১৭২৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি তাঁর প্রশাসনিক রাজধানী সাতারা থেকে পুনেতে স্থানান্তরিত করেন।
  • প্রথম বাজিরাওয়ের সময় নাদির শাহ ভারত আক্রমণ করেন।
  • সমগ্র ভারতের হিন্দু জাতির মধ্যে জাতীয়তাবােধজাগাবার উদ্দেশ্যে এবং হিন্দু দলপতিগণকে একই আদর্শে উদ্বুদ্ধ করবার জন্য বাজীরাও তাঁর ‘হিন্দু পাদ পাদশাহী’ বা হিন্দু সাম্রাজ্য গঠনের পরিকল্পনা সকলের সম্মুখে তুলে ধরেন।
  • প্রথম বাজিরাও স্থানীয় মারাঠা প্রশাসনিক প্রধান ( system of confederacy ) তৈরী করেছিলেন । এই সিস্টেমে কিছু স্বশাসিত মারাঠা প্রধান/ পরিবার প্রথম বাজিরাওয়ের অধীনে নিজ নিজ অঞ্চল শাসন করতেন । এদের মধ্যে বিখ্যাত ছিল – বরোদার গায়কোয়ার, নাগপুরের ভোঁসলে, ইন্দোরের হোলকার, গোয়ালিয়রের সিন্ধিয়া।
  • প্রথম বাজিরাওকে বলা হয় মারাঠা জাতির নেপােলিয়ান ও মারাঠা জাতির দ্বিতীয় প্রতিষ্ঠাতা।

বালাজি বাজিরাও (১৭৪০-১৭৬১)

  • বাজীরাও-এর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্রবালাজি বাজিরাও পেশোয়া পদ লাভ করেন।
  • ১৭৪৯ খ্রিস্টাব্দে শাহুর মৃত্যুর পর রাজারামকে সিংহাসনে বসান এবং পরবর্তীকালে তাকে সাতারায় বন্দী করে রাখেন এবং সঙ্গলা চুক্তি ( ১৭৫০ খ্রিস্টাব্দ ) -এর মাধ্যমে মারাঠা শাসনের ভার পেশোয়ারা পেয়ে যায়।।
  • ১৭৫২ খ্রিস্টাব্দে মুঘল সম্রাট আহম্মদ শাহের সঙ্গে তাঁর সন্ধি হয়। মুঘল সম্রাট উত্তর পশ্চিম সীমান্ত অঞ্চল, আগ্রা ও আজমীরের চৌথ আদায়ের দায়িত্ব বালাজি বাজিরাওকে দেন।
  • পিতার গৃহীত আদর্শ হিন্দু-পাদ-পাদশাহী ত্যাগ করে তিনি হিন্দু রাজাদের বিরুদ্ধেও যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন।
  • তার আমলে মারাঠারা, মহীশূর,কর্ণাটক, অ্যাটক এবং পাঞ্জাব দখল করে।
  • ১৭৬০ খ্রিস্টাব্দে উদগীরের যুদ্ধে মারাঠারা নিজামকে পরাস্ত করে।
  • ১৭৫১ খ্রিস্টাব্দে বাংলার নবাব আলিবর্দী খাঁর সঙ্গে মারাঠাদের সন্ধি হয় ও আলিবর্দী বার্ষিক ১২লক্ষ টাকা দেবার প্রতিশ্রুতি দেন।
  • তিনি সাম্রাজ্য বিস্তারের সময় পাঞ্জাব অধিকার করলে আহম্মদ শাহ আবদালীর সঙ্গে যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে পড়ে।
  • ১৭৬১ খ্রিস্টাব্দে পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধে আফগান নেতা আহম্মদশাহ আবদালীর হাতে মারাঠারা পরাস্ত হয়।
  • বালাজি বাজিরাও-এর ভাই সদাশিব রাও, পুত্র বিশ্বাস রাওসহ অন্যান্য মারাঠা নেতা এবং ১৮ হাজার মারাঠা সেনা নিহত হয়। বালাজি বাজিরাও ভগ্ন হৃদয়ে ১৭৬১ খ্রিস্টাব্দে ২৩ জুন মারা যান।

প্রথম মাধবরাও (১৭৬১-১৭৭২)

  • বালাজি বাজীরাও-এর মৃত্যুর পর তাঁর ১৭ বছর বয়সী পুত্র মাধবরাও পেশােয়া হন।
  • মালব ও বুন্দেলখন্ড মারাঠা সাম্রাজ্যভুক্ত করেন এবং জাঠ ও রাজপুতরা মারাঠাদের চৌথ দানে বাধ্য হয়।
  • মুঘলসম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলমকে দিল্লীর সিংহাসনে বসতে সাহায্য করেন এবং হায়দারআলিকে সন্ধি স্বাক্ষরে বাধ্য করেন।
  • ১৭৬২ খ্রিস্টাব্দে নিজামের কাছে মারাঠারা পরাস্ত হয় ও নিজাম শিবানির দৌলতাবাদ, আসীরগড় ও আহম্মদনগর দুর্গ দখল করেন।
  • ১৭৬৩ খ্রিস্টাব্দে নিজাম পুনা লুঠ করেন জ্ঞানজি ভোসলে গােপাল রাও পটবর্ধনের সহযােগিতায়।
  • ১৭৬৩ খ্রিস্টাব্দে রাক্ষসভূবনের যুদ্ধে মারাঠার নিজাম সেনাপতি ভিত্তাল সুন্দরকে পরাস্ত করেন।
  • ১৭৭২ খ্রিস্টাব্দে প্রথম মাধবরাওয়ের মৃত্যু হয়। দ্বিতীয় শাহ আলমকে সিংহাসনে বসানাের জন্য তিনি মহাদজি সিন্ধিয়াকে পাঠান।

নারায়ণ রাও (১৭৭২-১৭৭৩)

  • নারায়ণ রাও সিংহাসনে বসলে কাকা রঘুনাথ রাও তাকে হত্যা করে ১৭৭৩ খ্রিস্টাব্দে নিজে পেশােয়াপদ দখল করেন।
  • কিন্তু নানাফড়নবীশ ও অন্যান্য মারাঠা নেতা রঘুনাথ রাওকে মানতে অস্বীকার করেন এবং মৃতনারায়ণ রাওয়ের বিধবা পত্নী গঙ্গাবাই এর একটি পুত্রসন্তান হলে মারাঠা নেতৃবৃন্দ রঘুনাথ রাওকে বিতাড়িত করে ১৭৭৪ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় মাধবরাও বা মাধবরাও নারায়ণকে পেশােয়া পদে প্রতিষ্ঠিত করেন।

সওয়াই মাধব রাও ( ১৭৭২ – ১৭৭৩ খ্রিস্টাব্দ )

  • মাত্র ৪০ দিন বয়সে পেশোয়া পদের দায়িত্ব পান নারায়ণ রাও -এর পুত্র সওয়াই মাধব রাও।
  • প্রকৃত পক্ষে শাসনের ভার এসে পরে নানা ফড়নবিশ ওপরে। তাঁর সুশাসন ও বুদ্ধির জন্য নানা ফড়নবিশকে মারাঠা সাম্রাজ্যের চাণক্য বলা হতো।
  • অপরদিকে রঘুনাথ রাও পদচ্যুত হওয়ার পরে ব্রিটিশদের কাছে সাহায্য চান এবং প্রথম এংলো-মারাঠা যুদ্ধ ( ১৭৭৫-৮২ খ্রিস্টাব্দ ) শুরু হয় ।
  • বিখ্যাত তালেগাঁও এর যুদ্ধে ( ১৭৭৬ খ্রিষ্টাব্দ ) নানা ফড়নবিশ ব্রিটিশদের হারিয়ে দেন এবং ১৭৭৬ খ্রিস্টাব্দে তাদের মধ্যে পুরন্দরের সন্ধি এবং ১৭৮২ খ্রিষ্টাব্দে সলবাই -এর সন্ধি হয় এবং দ্বিতীয় মাধব রাওকে পেশোয়া বলে কোম্পানি স্বীকৃতি দেয় ।
  • ১৭৯৫ খ্রিস্টাব্দে নিঃসন্তান দ্বিতীয় মাধব রাও আত্মহত্যা করলে মারাঠাদের ঘরোয়া গোলমাল আবার প্রকট হয় । এবারও ফড়নবিশ তা সামাল দেন ।
  • ‘ভারতের মেকিয়াভেলি’ উপাধিতে ভূষিত নানা ফড়নবিশ যেভাবে অন্তর্কলহে দীর্ণ মারাঠা সাম্রাজ্যের সংহতি রক্ষা করেছিলেন তাতে তাঁর অসামান্য দেশপ্রেমের পরিচয় মেলে ।
  • ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে নানা ফড়নবিশ-এর মৃত্যুর পরে মারাঠা শক্তি আর বিশেষ মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি।

দ্বিতীয় বাজিরাও ( ১৭৯১ – ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দ )

  • দ্বিতীয় বাজিরাও ছিলেন রঘুনাথ রাও এর সন্তান এবং শেষ পেশোয়া।
  • তিনি ছিলেন সবথেকে দুর্বল ও ভীরু পেশোয়া এবং ১৮০২ খ্রিস্টাব্দে তিনি ব্রিটিশদের সাথে লজ্জাজনক বেসিনের সন্ধি স্বাক্ষর করেন। এর সন্ধির মাধ্যমে মারাঠা সাম্রাজ্য ও দাক্ষিণাত্যের প্রকৃত শাসনভার পেয়ে যায় ব্রিটিশরা।
  • ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় বাজীরাওকে ব্রিটিশরা সম্পুর্নরূপে পরাজিত করেন।
  • দ্বিতীয় বাজিরাও-এর দত্তক পুত্র ছিলেন নানা সাহেব বা ধুন্দুপন্থ । এই নানা সাহেব সিপাহী বিদ্রোহে অংশগ্রহণ করেছিলেন ।

পেশােয়াদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ছিলেন প্রথম বাজীরাও এবং দুর্বলতম পেশােয়া ছিলেন দ্বিতীয় বাজীরাও।